Marxists Internet Archive
Bangla Section


জার্মান ভাবাদর্শ

কার্ল মার্কস


সূচীপত্র

১. সাধারণভাবে আদর্শ, বিশেষভাবে জার্মান আদর্শ

জার্মান সমালোচনার তাজা চেষ্টাটা পর্যন্ত সে দর্শন রাজ্যের বাইরে যায় নি। এর সাধারণ দার্শনিক প্রাক-সিদ্ধান্ত(৬) নিয়ে অনুসন্ধান দূরে থাকুক, বরং এর অনুসন্ধানের পুরো শরীর আসলে ছিটকে বেরিয়েছে একটা নির্দিষ্ট দার্শনিক পদ্ধতির জমিন হতে। ঐ পদ্ধতিটা হচ্ছে হেগেলীয় দর্শন। তাদের প্রতিটা উত্তরই শুধু নয়, প্রতিটা প্রশ্নই ছিল রহস্যীকরণ। হেগেলের উপর নির্ভরতার কারণেই আধুনিক সমালোচকদের একজনও হেগেলীয় পদ্ধতির পুঙ্খানুপুঙ্খ সমালোচনা করেন না। যদিও প্রত্যেকেরই দাবি তারা হেগেলকে ছাড়িয়ে গেছেন। তারা প্রত্যেকেই হেগেল থেকে কিছু নিয়ে তাই-ই আবার হেগেল আর একে অপরের বিরুদ্ধে লাগান। হেগেল আর পরস্পরের সাথে বাদ-বিবাদগুলো এতটুকুর মধ্যেই আবদ্ধ। শুরু করার খাতিরে তারা নিখাদ অবিকৃত হেগেলীয় ক্যাটেগরী যেমন জ্ঞজ্ঞউপাদানঞ্চঞ্চ এবং আত্ম-চৈতন্যঞ্চঞ্চ আলগা করে নেন, পরে তারা এই ক্যাটেগরীগুলোকে আরো বেশি পার্থিব নাম যেমন জ্ঞজ্ঞপ্রজাতিঞ্চঞ্চ, জ্ঞজ্ঞঅনন্যঞ্চঞ্চ, জ্ঞজ্ঞমানুষঞ্চঞ্চ এই সবে বদলে নেন।
স্ট্রস থেকে স্টার্নার পর্যন্ত জার্মান দার্শনিক সমালোচনা পুরোটাই ধর্মীয় ধারণার সমালোচনায় আবদ্ধ। এই সমালোচকেরা শুরু করলেন জ্ঞজ্ঞবাস্তব ধর্মঞ্চঞ্চ আর জ্ঞজ্ঞযথাযথ ধর্মতত্ত্বঞ্চঞ্চ হতে। তারা যতই এগোতে লাগলেন ততোই বিভিন্নভাবে নির্ধারিত হতে লাগলো ধর্মীয় চৈতন্য কি আর ধর্মীয় ধারণার আসল মানে কি। তাদের অগ্রযাত্রাতে প্রভাব বিস্তারী অধিবিদ্যা রাজনৈতিক, ফৌজদারী, নৈতিক এবং অন্যান্য ধারণাসমূহ ধর্মীয় বা ধর্মতাত্ত্বিক শ্রেণীতে(৭) বাঁধা পড়তে লাগলো। একইভাবে রাজনৈতিক, ফৌজদারী, নৈতিক- সব মিলিয়ে তারা মানুষকে জ্ঞধর্মীয়ঞ্চ বলে ঘোষণা করলেন। ধর্মের আধিপত্য কবুল করা হয়েছিল। ক্রমশ সবগুলো প্রভাব বিস্তারী সম্পর্ক ধর্মীয় সম্পর্ক বলে বর্ণিত হলো, রূপ নিলো তন্ত্রের; আইন তন্ত্র, রাষ্ট্রের তন্ত্র ইত্যাদি। সবদিক দিয়েই এটা ছিল কিছু অন্ধমতের আর তাতে বিশ্বাসের প্রশ্ন। জগতকে এক চির বর্ধিত সীমা পর্যন্ত পবিত্র করে সাফাই করা চলছিল। শেষ পর্যন্ত আমাদের পরমমান্য সাধু জ্ঞম্যাক্সঞ্চ(৮) বাবাজী তাকে শাস্ত্রবদ্ধ করে থামালেন। এভাবে একে থামানো গেল চিরতরে।
যখনই একে একটা হেগেলীয় লজিকীয় ক্যাটেগরিতে এনে ঠেসে ঢোকানো হল, সঙ্গে সঙ্গে পুরনো হেগেলপন্থীরা সব বুঝে ফেললেন। নব্য হেগেলপন্থীরা সবকিছুর উপর ধর্মীয় ধারণা চাপিয়ে দিয়ে নয়তো একে ধর্মতত্ত্বের ব্যাপার বলে সমালোচনা করেন। ধর্মের নিয়মকানুন, ধারণা, আর বিদ্যমান জগতের অমূর্ত মূলনীতি সম্পর্কে বিশ্বাসগুলো নিয়ে পুরনো আর নব্য হেগেলপন্থীরা এক সুতোয় বাঁধা। শুধুমাত্র একপক্ষ এই রাজত্বকে আক্রমণ করে অন্যায় দখল হিসেবে, অপরপক্ষ তাকে বলে বৈধ।
নব্য হেগেলপন্থীরা ধারণা, চিন্তা, ভাব- আসলে মানুষের চেতনার সব উৎপাদঞ্চর উপরই আরোপ করেন স্বাধীন অস্তিত্ব আর এগুলোকে বিবেচনা করেন মানুষের বাস্তব শৃঙ্খল হিসেবে (ঠিক যেমন করে পুরনো হেগেলপন্থীরা এগুলোকে আখ্যা দিয়েছেন মানব সমাজের সত্যকারের শৃঙ্খল বলে)। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে, নব্য হেগেলপন্থীদের শুধুমাত্র চেতনার এই মায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। তাদের ফ্যান্টাসী অনুসারে, মানুষদের মাঝের সম্পর্ক, তাদের সব কাজ, তাদের শৃঙ্খল, সীমাবদ্ধতা- সবই তার চেতনার উৎপাদ। নব্য হেগেলপন্থীরা তাই যৌক্তিকভাবে মানুষের সামনে মানবিক, সমালোচনামূলক বা অহংতন্ত্রী চৈতন্য দিয়ে তাদের বর্তমান চৈতন্যকে বিনিময়ের নৈতিক স্বতঃসিদ্ধ হাজির করেন। এভাবেই তারা মানুষের সীমাবদ্ধতা দূর করতে চান।(৯) চৈতন্যকে পরিবর্তনের এই দাবির মানে হচ্ছে বাস্তবতাকে অন্য কোন ভাবে ব্যাখ্যা করা। তারমানে, অন্য কোন ব্যাখ্যার সাহায্যে একে গ্রহণ করা। নব্য হেগেলপন্থী আদর্শবাদীরা জ্ঞদুনিয়া কাঁপানোঞ্চ তাদের এই সব মন্তব্য সত্ত্বেও একেবারে গোড়া রক্ষণশীল। তাদের মধ্যে একেবারে নতুনেরা যখন বলেন যে তারা শুধুমাত্র কিছু জ্ঞবোলচালেরঞ্চ বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন, সে মুহূর্তে তারা তাদের কাজের সঠিক প্রকাশটি খুঁজে পান; তবে ভুলে যান যে এই সব বোলচালের বিপরীতে তারা নিজেরাও এর উল্টো কিছু বোলচাল মাত্র। যখন তারা এই জগতের বোলচালের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, সে লড়াই কিন্তু বিদ্যমান জগতের বিরুদ্ধে লড়াই নয়। এই দার্শনিক সমালোচনা যা দিতে পারে তা হচ্ছে ধর্মীয় ইতিহাসের দৃষ্টিভঙ্গি হতে খৃষ্টানতন্ত্রের সামান্য কিছু স্পষ্ট (এবং সম্পূর্ণ একপেশে) আলোকপাত। বাকীটুকু এসব গুরুত্বহীন আলোকপাতের মাঝে বিশ্বজনীন মাহাত্ম, আবিষ্কারের দাবি আর তাই নিয়ে আরো কিছু বাগাড়ম্বর। জার্মান দর্শনের সাথে জার্মান বাস্তবতার আর তাদের সমালোচনার সাথে তাদের পরিপার্শ্বের বস্তুগত অবস্থার সম্পর্ক নির্ণয়ের কথা এসব দার্শনিকদের কারো মাথায় আসেনি।
মৌলিক যে ক্ষেত্র হতে আমরা শুরু করছি তা ঐচ্ছিক নয়, কোন অন্ধমত নয়; বরং বাস্তব ক্ষেত্র- যা থেকে কেবলমাত্র কল্পনাতেই অমূর্তকরণ করা যায়। তারা হচ্ছে বাস্তব ব্যক্তি, তাদের কাজ কারবার আর বহাল পাওয়া ও তাদের কাজ কারবারে উৎপন্ন উভয় রকমের বস্তুগত শর্ত- যার অধীনে তারা বাস করে। এভাবে এই ক্ষেত্রগুলো একটা নিখাদ অভিঞ্চতাতান্ত্রিক পথে শনাক্ত করা যায়।
সকল মানব ইতিহাসের প্রথম ক্ষেত্র অবশ্যই জীবন্ত মানব এককের অস্তিত্ব। তাই প্রথমেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে এই সব স্বতন্ত্রের শরীরবৃত্তিক সংগঠন আর বাকি প্রকৃতির সাথে তাদের তৎপরবর্তী সম্পর্ক। মানুষের প্রকৃত শরীরবৃত্তিক প্রকৃতি বা যে বহাল প্রাকৃতিক শর্তে সে নিজেকে পায় (যেমন- ভূ-তাত্ত্বিক, জলাংশগত, আবহাওয়াগত) তার কোনটাতেই যাওয়া যাবে না। ইতিহাস লিখন সবসময়ই শুরু করা উচিত এই স্বাভাবিক ভিত্তি আর ইতিহাসে মানুষের কাজ কারবারের মাঝ দিয়ে এর পরিশীলন হতে।
মানুষকে জানোয়ার থেকে আলাদা করা যায় চৈতন্য, ধর্ম বা তোমার পছন্দ অন্য কিছু দিয়ে। মানুষ নিজেরাই জানোয়ার থেকে নিজেদের আলাদা করে ফেলে- যখন তারা অস্তিত্ব রক্ষার উপকরণ উৎপাদন শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটি এমন একটি ধাপ যা শরীরবৃত্তিক সংগঠন দ্বারা শর্তায়িত। অস্তিত্ব রক্ষার উপায় উৎপাদনের মাধ্যমে মানুষ পরোক্ষভাবে তাদের বাস্তব বস্তুগত জীবন উৎপাদন করে। যে পথে মানুষ অস্তিত্ব রক্ষার উপায় উৎপাদন করে তা সবার আগে নির্ভর করে বহাল থাকা বাস্তব উপায় আর যা পুনরুৎপাদন করতে হবে তার স্বভাবের উপর। উৎপাদনের এই ধরণকে কোন মতেই সরলভাবে স্বতন্ত্রের শরীরবৃত্তিক অস্তিত্বের পুনরুৎপাদন হিসেবে বিচার করলে চলবে না। বরং তা এই স্বতন্ত্রদের কাজ কারবারের, তাদের জীবনকে প্রকাশের একটা নির্দিষ্ট আঙ্গিক, তাদের জন্য একটা নির্দিষ্ট জীবনের ধরণ । স্বতন্ত্রেরা যেমন করে জীবনকে প্রকাশ করে, তারা তেমনই। তাই, তারা একই সাথে যুক্ত- তারা কি দিয়ে উৎপাদন করে আর তা দিয়ে কি করে উৎপাদন করে- এই উৎপাদন ক্রিয়ার সাথে। তাদের উৎপাদন নির্ধারণকারী বস্তুগত শর্তের উপর তাই স্বতন্ত্রদের প্রকৃতি নির্ভর করে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথেই শুধুমাত্র এই উৎপাদন নিজের আভাস দেয়। নিজের বেলায় তা স্বতন্ত্রদের একে অপরের সাথে মেলামেশা পূর্বানুমিত করে। আবার এই মেলামেশার আঙ্গিক নির্ধারিত হয় উৎপাদন দিয়ে।
বিভিন্ন জাতির নিজেদের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ভর করে তারা প্রত্যেকে নিজেদের উৎপাদন শক্তির কতটা বিকাশ করেছে, শ্রম বিভাজন এবং ভেতরকার মেলামেশার মাত্রা কতটুকু তার উপর।(১০) এই কথা মোটামুটি সবাই মানে। কিন্তু জাতিগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক শুধু নয়, জাতিটির নিজের পুরো ভেতরের কাঠামোও নির্ভর করে এর উৎপাদনের দ্বারা অর্জিত বিকাশের স্তর ও এর বাইরের আর ভেতরের মেলামেশাঞ্চর ওপর। কোন জাতির উৎপাদনী শক্তি কতদূর বিকশিত হয়েছে তা সব চাইতে নজরকাড়া চেহারায় দেখানো থাকে শ্রমের বিভাজন কতটা এগিয়েছে তার মাত্রায়। প্রতিটি নতুন উৎপাদনী শক্তি , যদি না তা শুধু বিদ্যমান উৎপাদনী শক্তির পরিমাণগত বিস্তার হয় (যেমন চাষাবাদের নতুন জমি তৈরী), শ্রম বিভাজনের পরবর্তী বিকাশ ঘটায়। জাতির মধ্যে শ্রম বিভাজন সবচেঞ্চ আগে শিল্প-বাণিজ্যিক শ্রম ও চাষাবাদের শ্রমকে পৃথক করে। আর এমনি করে বিভাজিত হয় শহর এবং গ্রাম, সংঘাত বাঁধে তাদের স্বার্থে। এর আরো বিকাশ বাণিজ্যিক এবং শিল্প কারখানার শ্রমের মাঝে বিভাজন তৈরী করে। একই সময়ে এই শ্রম বিভাজনের মধ্যে দিয়ে, এইসব অনেক ডালপালার ভেতরে, নির্দিষ্ট ধরণের শ্রমে এক সাথে কাজকরনেওয়ালা স্বতন্ত্রদের মাঝে বহুবিধ বিভাজন বেড়ে উঠে। এই সব স্বতন্ত্র দলের আপেক্ষিক অবস্থান নির্দিষ্ট হয় কৃষি, শিল্প আর বাণিজ্যে প্রযুক্ত পদ্ধতি দিয়ে (পিতৃতান্ত্রিকতা, দাসতন্ত্র, এস্টেট, শ্রেণী)। একই অবস্থা দেখা যাবে (আরো বিকশিত মেলামেশায়) বিভিন্ন জাতির পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে।
শ্রম বিভাজনে বিকাশের বিভিন্ন স্তর আর মালিকানার বহু বিভিন্ন আঙ্গিক একই কথা। যেমন শ্রম বিভাজনের বিদ্যমান স্তর স্বতন্ত্রদের নিজেদের মাঝের সম্পর্ক, বস্তুগত হাতিয়ার আর শ্রমের উৎপাদের প্রেক্ষিত নির্ধারণ করে।
মালিকানার প্রথম আঙ্গিক হল গোত্রগত। এটা উৎপাদনের অবিকশিত পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত। মানুষ এখানে শিকার, মাছধরা, পশুপালন- খুব উঁচুতে গেলে কৃষিকাজ করে বেঁচে থাকে। এ স্তরে শ্রম বিভাজন পদ্ধতি খুবই প্রাথমিক পর্যায়ের এবং পরিবারের কাছ হতে পাওয়া স্বাভাবিক শ্রম বিভাজনের আরো বিস্তৃতি পর্যন্ত আবদ্ধ। তাই সামাজিক কাঠামো সীমিত পরিবারের বিস্তৃতি, পিতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রধান, তাদের নিচে গোত্র সদস্য, একেবারে শেষে দাস পর্যন্ত। পরিবারের ভেতরে সুপ্ত দাস ব্যবস্থা শুধুমাত্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অভাব বৃদ্ধি, আর বর্ধিত বাইরের সম্পর্কের (যুদ্ধ বা ব্যবসার) সাথে ক্রমাগত বিকশিত হয়।
দ্বিতীয় আঙ্গিকটি হল প্রাচীন গণ এবং রাষ্ট্র মালিকানা। এটি শুরু হয় বিশেষ করে চুক্তি বা জিতে নিয়ে, কয়েকটি গোত্রের একত্রিকরণের সাহায্যে শহর সৃষ্টি হয়ে। তার সাথে সাথে তখনো দাস প্রথা চলছে। গণ মালিকানার পাশাপাশি প্রথমে স্থাবর অস্থাবর(১১) পরে ব্যক্তি সম্পত্তি বিকশিত হতে দেখতে পাই; যদিও তা গণ অধিকারের অনুসঙ্গে একটি বিকৃত আঙ্গিক হিসেবে। শুধুমাত্র গণ সদস্য হিসেবেই নাগরিকেরা শ্রমদানকারী দাসদের উপর ক্ষমতা রাখতো। কেবল একারণেই তারা গণ মালিকানার আঙ্গিকের কাছে বাধ্যগত। এই গণ ব্যক্তিসম্পত্তিই সক্রিয় নাগরিকদের তাদের দাসদের বিপরীতে স্থাপিত সংগঠনের স্বাভাবিক আঙ্গিকে(১২) থাকতে বাধ্য করতো। এ কারণে সমাজের পুরো কাঠামোর ভিত্তি ছিল এই গণ মালিকানা। স্থাবর ব্যক্তি সম্পত্তি যত বাড়তে লাগলো, সমান মাপে জনগণের ক্ষমতা কমতে লাগলো। শ্রম বিভাজন ইতঃমধ্যেই আরো বিকশিত হয়েছে। আমরা এর মধ্যেই দেখতে পাই শহর আর গ্রামের ঠোকাঠুকি। পরে, সেই সব রাষ্ট্র যারা শহরের স্বার্থ আর যারা গ্রামের স্বার্থ প্রতিনিধিত্ব করে, তাদের মাঝে আর খোদ শহরের ভেতরে শিল্প এবং নৌ বাণিজ্যের ঠোকাঠুকি দেখা দিল। তখন নাগরিক আর দাসদের শ্রেণী সম্পর্ক পুরোপুরি বিকশিত হয়ে যায়।
ইতিহাসের পুরো ব্যাখ্যাই মনে হয় যেন জয় পরাজয়ের ঘটনার দ্বন্দ্ব। এখন পর্যন্ত হানাহানি, যুদ্ধ, ধর্ষণ, লুন্ঠন এবং গণহত্যাকে মেনে নেয়া হয়েছে ইতিহাসের চালিকা শক্তি হিসেবে। এখানে আমরা প্রধান বিন্দুটির মাঝেই নিজেদের আবদ্ধ রেখে একটা দূর্দান্ত উদাহরণ নিই, তা হল- কোন বর্বর গোষ্ঠী দ্বারা একটি পুরনো সভ্যতার পতন ও ফল স্বরূপ আপাদ মস্তক নতুন একটা সমাজের সৃষ্টি (রোম এবং বর্বর; সামন্ততন্ত্র এবং গল; বাইজেন্টাইন এবং তুর্কীরা)। বিজয়ী বর্বরদের কাছে খোদ যুদ্ধ তখনো, উপরে যেমন আভাস দেয়া হয়েছে, মেলামেশার একটি স্বাভাবিক আঙ্গিক। জনসংখ্যা যত বাড়লো, প্রয়োজন পড়লো ঐতিহ্যবাহীকে অতিক্রম করা উৎপাদনের নতুন উপায়। তার জন্য যুদ্ধকেই সব চাইতে উদ্যমের সাথে ব্যবহার করা গেল একমাত্র সম্ভাব্য, আকাট উৎপাদনের ধরণ হিসেবে। ইতালিতে ব্যাপারটা ছিল অন্যরকম। ভূমি সম্পত্তির একত্রিকরণ (শুধুমাত্র বিক্রয় এবং দেনাদারীত্বের কারণেই নয়, তার সাথে ছিল উত্তরাধিকার পদ্ধতি, গাছাড়া ভাবে জীবন যাপন আর বিয়ে কমে যাওয়ার ফলে পুরনো বংশগুলোর বিলোপ আর তাদের সম্পদ স্বল্পকিছু লোকের হাতে জমা হবার ফল) এবং ভূসম্পত্তি ও চারণ ভূমিতে বদলে ফেলার ফলে (এখনও ক্রিয়াশীল অর্থনৈতিক শক্তিসমূহই শুধু নয়, লুন্ঠিত ও উপঢৌকন হিসেবে পাওয়া শষ্যের আগমনের ফলে ইতালিয় শস্যের চাহিদা কমে যাওয়াও এর কারণ) স্বাধীন জনগণের পরিমাণ প্রায় উঠে গেল। একই দাসেরা বারবার মরতে লাগলো আর অফুরন্ত জোগানে নতুনেরা তার জায়গা নিল। পুরো উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভিত্তি রয়ে গেল দাস ব্যবস্থা। স্বাধীন মানুষ আর দাসদের মাঝে থাকা মধ্যস্তরে অবস্থানকারী প্লীবিয়ানরা কখনো প্রলেতারীয় হুল্লোড় ছাড়া আর কিছু হতে পারেনি। আসলে রোম কখনোই একটা শহরের চাইতে বেশি কিছু হতে পারেনি। প্রদেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল একেবারে বাহ্যিক রাজনৈতিক আর তাই আবার রাজনৈতিক ঘটনা ঘটিয়েই তা ভাঙা যেত।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিকাশের সাথে সাথে আমরা এখানে প্রথমবারের মত সেই একই শর্তগুলো দেখতে পাই যা আমরা আবার দেখতে পাবো শুধুমাত্র আরো বিস্তৃত মাত্রায়, আধুনিক ব্যক্তিসম্পত্তিতে। একদিকে ব্যক্তিসম্পত্তির একীভূতকরণ- যা রোমে অনেক আগেই শুরু হয়েছিল (লাইসিনীয় কৃষি আইন যেমন প্রমাণ দেয়(১৩) আর গৃহযুদ্ধ এবং সম্রাটদেরকালে এর দ্রুত বৃদ্ধি হয়েছিল; অপরদিকে এর সাথে জোড় বেঁধে, প্লীবিয়ান ছোট গেরস্থদের সর্বহারায় রূপান্তর- এই প্লীবিয়ানরা মধ্যবর্তী পর্যায়ে সম্পত্তিশালী নাগরিক আর দাসদের মাঝে ছিল, কখনোই স্বাধীন বিকাশ অর্জন করেনি।
অধিকারের তৃতীয় রূপটি হল সামন্ততান্ত্রিক বা জমিদারী সম্পদ(১৪)। যদি প্রাচীনযুগের শুরু হয় শহরের ছোট গন্ডি হতে, তবে মধ্যযুগ যাত্রা শুরু করে গ্রাম থেকে। এই ভিন্ন যাত্রা বিন্দু নির্ধারিত হয়েছিল ঐ কালে পাতলাভাবে ছড়ানো জনগোষ্ঠী দিয়ে। ঐ জনগোষ্ঠী ছড়িয়েছিল বিশাল এলাকা নিয়ে আর বিজয়ী জনগোষ্ঠীও তার সংখ্যা বাড়ায়নি। গ্রীস ও রোমের ক্ষেত্রে দেখা যাক- রোমের বিজয় অভিযান আর তার সাথে প্রথমেই জুড়ে দেয়া কৃষির বিকাশের ফলে সামন্তীয় বিকাশ ছিল আরো বড় জায়গা নিয়ে। পড়ন্ত রোম সাম্রাজ্যের শেষ শতকগুলো আর বর্বরদের দখল অনেক উৎপাদনী শক্তি ধ্বংস করে। কৃষি নষ্ট নয়তো তুমুল বাধা পায়, শহর ও গ্রামের লোকসংখ্যা কমে যায়। এসব অবস্থা এবং তাদের নির্ধারিত সংগঠনের আঙ্গিকের ফলে সামন্ত সম্পত্তি বিকশিত হয় জার্মান সামরিক বিধানের প্রভাবে। গোত্র বা গণ অধিকারের মত আবার এর ভিত্তি হল জনসম্প্রদায়। তবে এর উপর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো, সরাসরি উৎপাদনকারী গোষ্ঠী কিন্তু প্রাচীন জনসম্প্রদায়ে যেমন ছিল, সেই দাসেরা নয়। এবার তারা ভূমিদাস করে নেয়া ক্ষুদ্র কৃষক শ্রেণী। যখনই সামন্ততন্ত্র পূর্ণ বিকশিত হল, শহরের সাথে ঠোকাঠুকিও শুরু হয়ে গেল। ভূমি অধিকারের ক্রম উচ্চ পদ্ধতি আর তার সাথে যুক্ত তাদের সশস্ত্র অনুচরবাহিনী ভূমিদাসদের উপর অভিজাতদের কর্তৃত্ব দান করলো। পুরনো গণ অধিকার পদ্ধতির মতোই এই সামন্ত সংগঠন ছিল অধীনস্ত উৎপাদনকারী শ্রেণীর বিরুদ্ধে একটি সংঘ। তবে উৎপাদনের অবস্থার ভিন্নতার কারণে সংঘের আঙ্গিক আর সরাসরি উৎপাদকদের সাথে এর সম্পর্ক ছিল ভিন্ন।
ভূমি মালিকানার সামন্ত সংগঠনের পাল্টা অংশটি ছিল শহরে, ব্যবসার সামন্তীয় ব্যবস্থা সম্পত্তির যৌথ সংস্থার চেহারায়। এখানে সম্পত্তি গঠিত ছিল প্রত্যেক স্বতন্ত্র মানুষের শ্রমের উপর। সংগঠিত লুটেরা অভিজাতদের বিরুদ্ধে সংঘের প্রয়োজনীয়তা, যখন শিল্পপতি একই সাথে বণিক তখন জনসম্প্রদায় বাজারের চাহিদা, উদীয়মান শহরে পালিয়ে যাওয়া ভূমিদাসদের উপচে পড়া প্রতিযোগিতা, পুরো দেশের সামন্তীয় কাঠামো- এই সব মিলে গড়ে উঠলো গিল্ডগুলো। অধিকন্তু, একক কারিগরদের কাছে ক্রমে জমে উঠা পুঁজির বৃদ্ধি, বর্ধনশীল জনসংখ্যার সাপেক্ষে তাদের স্থিত সংখ্যা তৈরী করলো অধীন কারিগর আর শিক্ষানবীশ সম্পর্ক। এই সম্পর্ক গ্রামের মতো শহরেও ক্রমউচ্চ সংগঠন পয়দা করে ফেললো।
এভাবে, সামন্ত কালপর্বে সম্পত্তির প্রধান আঙ্গিক দুঞ্চভাবে গঠিত ছিল। একদিকে ভূসম্পত্তি- যার সাথে শেকলযুক্ত ভূমিদাস; অপরদিকে ক্ষুদ্র পুঁজিসহ একক ব্যক্তির শ্রম- যা অধীন কারিগরদের চালনা করতো। উভয়ই নির্দিষ্ট হতো উৎপাদনের সীমাবদ্ধ শর্তাবলী- জমির আদিম এবং ছোট মাত্রার চাষ ও হস্তশিল্প ধরণের শিল্প দিয়ে। সামন্ততন্ত্রের যৌবনকালে শ্রম বিভাজন কমই ছিল। শহর আর গ্রামের দ্বন্দ্ব সব জায়গাতেই বজায় ছিল আর জমিদারী সম্পত্তির পার্থক্যগুলো খুব শক্তভাবে চিহ্নিত হত। গ্রামাঞ্চলে রাজরাজরাদের, অভিজাতদের, কেরানী আর চাষাদের পার্থক্য, আর শহরে ওস্তাদ কারিগর, অধীন কারিগর, নবীশ আর কঞ্চদিন পরেই ছুটা শ্রমিকদের হুল্লোড়ের পার্থক্য সত্ত্বেও কোন পার্থক্যই পাত্তা পেত না। কৃষিকাজে টুকরো জমি পদ্ধতি বেশ দুরূহ বলে প্রতীয়মান হল; তার সাথে যোগ হল কৃষকদের কুটির শিল্পগুলো। যোগ হল আরেকটি ব্যাপার হিসেবে। শিল্পের ক্ষেত্রে একক বাণিজ্যে কোন শ্রম বিভাজনই হয়নি, নিজেদের মাঝেও তা ছিল খুব কম। পুরনো শহরগুলোতে শিল্প এবং বাণিজ্যের বিভাজন আগেই হয়ে গিয়েছিল, নতুন করে তা হয়েছিল কেবল অন্যান্য শহরগুলোর সাথে মেলামেশার পর।
অপেক্ষাকৃত বড় অঞ্চলগুলোর সামন্ত রাজ্যে জোট বাঁধা শহরের মতোই ভূ-অধিকারী অভিজাতদের একটি প্রয়োজন ছিল। শাসক শ্রেণী, অভিজাতদের সংগঠনের মাথার উপরে সব জায়গাতেই ছিল একজন রাজা।
তাই আসল ব্যাপারটা হল, যে নির্দিষ্ট ব্যক্তিরা একটি নির্দিষ্ট পথে উৎপাদনশীলভাবে সক্রিয়, তারা এই সব নির্দিষ্ট সমাজ ও রাজনৈতিক সম্পর্কে ঢুকে পড়ে। প্রতিটি অবস্থাতেই অভিঞ্চতাগত পর্যবেক্ষণ কোন রহস্যীকরণ বা দূরকল্পনা ছাড়াই উৎপাদনের সাথে সামাজিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোর সম্পর্ক অভিঞ্চতাগত ভাবে বের করে আনবে। রাষ্ট্র এবং সমাজ কাঠামো নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের জীবন প্রক্রিয়ার গন্ডি হতে বিরামহীনভাবে বের হয়ে আসছিল। কিন্তু স্বতন্ত্রের ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের যেমন মনে হতে পারে বা মানুষেরা যেমন কল্পনা করে তারা তেমন নয়। বরং তারা আসলে যেমন সেটাই তাদের পরিচয়; তার মানে যেভাবে তারা প্রভাবশীল, বস্তুগত ভাবে উৎপাদনশীল, আর নির্দিষ্ট বস্তুগত সীমার অধীনে সক্রিয় তেমন। পূর্ব ধারণা এবং শর্তাদী তাদের ইচ্ছা নিরপেক্ষ।
ভাব, ধারণা, চৈতন্যের উৎপাদন প্রথমেই বস্তুগত মেলামেশায় সরাসরি একসাথে বোনা হয়ে যায়। এটাই জীবনের আসল ভাষা। এই স্তরে ধারণা করা, চিন্তা করা, মানুষের মননগত মেলামেশা প্রতিভাসিত হয় তাদের বস্তুগত আচরণের সরাসরি নির্যাস হিসেবে। একই কথা খাটে মানসিক উৎপাদনগুলোর ব্যাপারে, যেগুলোকে জনগণের রাজনীতি, আইন, নৈতিকতা, ধর্ম, অধিবিদ্যা ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হয়। মানুষই তাদের ধারণা, ভাব ইত্যাদির উৎপাদক। সে মানুষ বাস্তব, সক্রিয়, যেভাবে তারা তাদের উৎপাদনী শক্তির নির্দিষ্ট বিকাশ, তার সবচাইতে অগ্রবর্তী সীমায় এই বিকাশের সাথে সম্পৃক্ত মেলামেশা দিয়ে শর্তায়িত। চৈতন্য কখনই চেতন অস্তিত্ব ছাড়া অন্য কিছু হতে পারেনা। আর মানুষের অস্তিত্ব হচ্ছে তাদের বাস্তব জীবন প্রক্রিয়া। যদি সব ভাবাদর্শেই মানুষ আর তার প্রতিপার্শ্ব উল্টোভাবে প্রতিবিম্বিত হয়। তবে ঘটনাটা ঐতিহাসিক জীবন পদ্ধতিতে এমন ফল দেবে যেমন ফল পাওয়া যাবে আমাদের শরীর বৃত্তিক জীবন পদ্ধতিতে রেটিনায় প্রাপ্ত প্রতিবিম্বগুলো উল্টোভাবে পেলে।(১৫)
জার্মান দর্শন যেখানে আকাশ থেকে মাটিতে নামে তার সরাসরি বিপরীতে আমরা এখানে মাটি থেকে আকাশে উঠছি। তার মানে বললে দাঁড়ায়, রক্ত মাংসের মানুষে পৌঁছতে আমরা মানুষ যা বলে, কল্পনা করে, ধারণা করে, বা মানুষ সম্পর্কে যা বলা, ভাবা বা চিন্তা করা হয়েছে তার কোনটা থেকেই যাত্রা শুরু করিনি। আমরা যাত্রা করেছি বাস্তব, সক্রিয় মানুষ থেকে এবং তাদের বাস্তব জীবন পদ্ধতিকে ভিত্তি করে আমরা দেখিয়েছি এই জীবন প্রক্রিয়ার ভাবাদর্শিক প্রতিক্রিয়ার বিকাশ ও তার প্রতিধ্বনিগুলো, মানুষের মগজে তৈরী হওয়া মরীচিকাগুলোও প্রামাণিকভাবে তাদের বস্তুগত জীবন প্রক্রিয়ার ভয় লাগানো মহিমান্বিতকরণ। যারা অভিঞ্চতাগতভাবে নির্ণয়যোগ্য এবং বস্তুগত ক্ষেত্রে আবদ্ধ। নৈতিকতা, ধর্ম, অধিবিদ্যা, ভাবাদর্শের বাকীসব এবং তৎসম্পৃক্ত চৈতন্যের আঙ্গিক আর স্বাধীন হবার ছাপ মারা রইল না। তাদের কোন ইতিহাস, কোন বিকাশ নেই; কিন্তু মানুষ তার বস্তুগত উৎপাদন আর অন্যান্য বস্তুগত মেলামেশার বিকাশের সাথে সাথে তার বাস্তব অস্তিত্ব, তার চিন্তা আর চিন্তার উপাদানগুলোও বদলে ফেলে। চৈতন্য দিয়ে জীবন নয়, বরং জীবন দিয়েই চৈতন্য নির্দিষ্ট হয়। এগুনোর প্রথম পদ্ধতিতে জীবন্ত স্বতন্ত্রের মত করে যাত্রা বিন্দুতে চৈতন্যকে নেয়া হয়; দ্বিতীয়তে, খোদ বাস্তব জীবন্ত স্বতন্ত্র, তাদের আসল জীবন, আর চৈতন্যকে ধরা হয় কেবলমাত্র তাদেরই চৈতন্য হিসেবে।
প্রস্তাবনার এই পদ্ধতি প্রাকসিদ্ধান্তহীন নয়। এটা যাত্রা করে বাস্তব ক্ষেত্র হতে, আর এক মুহূর্তের জন্যেও তাদের পরিত্যাগ করেনা। এর প্রাকসিদ্ধান্ত হচ্ছে মানুষ, কোন রঙচঙে কল্পনার একাকীত্বে বা অমূর্ত সংঞ্চায় নয়, বরং তাদের বাস্তব, অভিঞ্চতাগতভাবে প্রত্যক্ষণযোগ্য নির্দিষ্ট শর্তের অধীনে বিকাশের প্রক্রিয়ায়। যখনই এই সক্রিয় জীবন প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়, ইতিহাস আর মৃত ঘটনার সমাহার থাকেনা, যেমন বলে অভিঞ্চতাবাদীরা (তারা নিজেরাও এখনো অমূর্ত), অথবা ভাববাদীদের মত কাল্পনিক বিষয়ীর কাল্পনিক ক্রিয়াকান্ডও থাকেনা।
বাস্তব জীবনেযেখানে দূরকল্পনা শেষ, সেখানে বাস্তব, ইতিবাচক বিঞ্চান শুরু হয় : হাতে কলমে কাজের উপস্থাপন, মানুষের বিকাশের প্রায়োগিক প্রক্রিয়ার বিঞ্চান। চৈতন্য নিয়ে ফাঁকা বুলি আওড়ানো থামে, আর এর জায়গা নিতে হয় বাস্তব ঞ্চানকে। বাস্তবতা উন্মোচিত হলে, স্বাধীন সক্রিয়তার শাখা হিসেবে দর্শন তার অস্তিত্বের মাধ্যম হারায়। এর জায়গা ভালোভাবে দখল করা যায় কেবলমাত্র সবচাইতে সাধারণ ফলাফলগুলোর সমষ্টি করে, অমূর্তায়ন করে, যা মানুষের ঐতিহাসিক বিকাশের পর্যবেক্ষণ থেকে উঠে আসে। বাস্তব ইতিহাস থেকে আলাদা হয়ে তাকালে এই অমূর্তায়নগুলোর যতই হোক নিজেদের কোন দাম নেই। তখন এগুলো শুধুমাত্র ইতিহাসের উপকরণগুলোর বিন্যাস, এর বিচ্ছিন্ন স্তরের ধারাবাহিক নির্দেশ করতে সুবিধা হওয়ার কাজে লাগানো যাবে। তাদের কাছে দর্শনের মত এমন কোন ব্যবস্থাপত্র নেই যা দিয়ে ইতিহাসের কালপর্বগুলোকে ঝাড়াই-বাছাই করা যায়। অপরদিকে, আমাদের ঝামেলা তখনি শুরু হয় যখন পর্যবেক্ষণ এবং আয়োজনগুলোকে সাজাতে যাই- যখনি আমাদের ঐতিহাসিক মালমশলা (তা আগেরকালের বা বর্তমানেরই হোক না কেন)কে বাস্তবভাবে খুঁটিনাটিসহ বর্ণনা করতে চাই। এ ঝামেলাগুলোর দূরবীক্ষণ যে প্রাকসিদ্ধান্ত দিয়ে শাসিত হয় তা এখানে বর্ণনা করা একেবারেই অসম্ভব। তবে তা প্রতি কালপর্বের বাস্তব জীবন প্রক্রিয়া এবং স্বতন্ত্রদের ক্রিয়াকলাপের অধ্যয়নই প্রামাণিক করে তুলবে। সেই সব অমূর্তকরণের কিছু আমরা এখানে বেছে নেব যা আমরা ভাবাদর্শবাদীদের খন্ডন করতে ব্যবহার করি। এগুলোকে ঐতিহাসিক উদাহরণ দিয়ে চিত্রিত করা হবে।

পরবর্তী অংশ