Marxists Internet Archive
Bangla Section
অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া
কার্ল মার্কস
প্রথম পান্ডুলিপি: বিচ্ছিন্ন করা শ্রম
আমরা অগ্রসর হয়েছি রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের প্রাক-সিদ্ধান্তগুলো হতে। আমরা এর ভাষা এবং নিয়মগুলো মেনে নিয়েছি। পূর্বানুমান করে নিয়েছি ব্যক্তি সম্পত্তি, শ্রমের পৃথকীকরণ, পুঁজি ও ভূমি, এবং মজুরী, পুঁজির মুনাফা এবং জমির খাজনা। এমনভাবেই পূর্বানুমান করেছি শ্রম বিভাগ, প্রতিযোগিতা, বিনিময়-মূল্যঞ্চর ধারণা ইত্যাদি। তা করেছি রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের নিজের ভিত্তিতে, খোদ এর নিজের কথাতেই। আমরা দেখিয়েছি যে শ্রমিকেরা ডুবে যায় একটা পণ্যের স্তরে- আদতে, নিজেরাই হয়ে ওঠে সবচাইতে দূর্দশাগ্রস্ত পণ্য বিশেষ। আরো দেখানো হয়েছে যে, শ্রমিকের এই দূর্দশা তার উৎপাদনের শক্তি এবং পরিমাণের ব্যস্তানুপাতিক; প্রতিযোগিতার প্রামাণিক ফলাফল হল অল্প কয়েক হাতে পুঁজির পুঞ্জিভবন। আর এভাবে একচেটিয়াপনা পুনরুত্থিত হয় আরো ভয়াবহ আঙ্গিকে। আরো প্রদর্শিত হয়েছে যে, শেষমেষ জমি চাষ করনেওয়ালা আর কারখানা শ্রমিকের মত পুঁজিপতি আর জমি ভাড়া খাটানেওয়ালার মাঝখানের পার্থক্য মিলিয়ে যায়। আর দেখিয়েছি যে, সমাজের পুরোটাই দুটো শ্রেণীতে ভাগ হয়ে পড়ে- সম্পত্তি মালিক আর সম্পত্তিহীন শ্রমিক।
রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র শুরু হয় ব্যক্তি সম্পত্তির বাস্তবতা থেকে। কিন্তু ব্যক্তি সম্পত্তির ব্যাপারটাই সে আমাদের কাছে খোলাসা করেনা। এটা মোটা দাগে অমূর্ত সূত্র- বস্তুগত প্রক্রিয়া প্রকাশ করে যার মাঝ দিয়ে আসলে ব্যক্তি সম্পত্তি অতিক্রমিত হয়, আর তখন এটা এই সূত্রগুলোকে নিয়ম বলে গ্রহণ করে নেয়। এটা এসব নিয়মকে অনুধাবণ করেনা, তার মানে, ঐ নিয়মগুলো ব্যক্তি সম্পত্তির স্বভাব হতেই কেমন করে উত্থিত হয় তা সে প্রদর্শন করেনা। রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র শ্রম ও পুঁজি এবং পুঁজি ও ভূমির মধ্যকার বিভাজনের কারণগুলোর ওপর আলোকপাত করেনা। উদাহরণ টেনে বলা যায়- সে যখন মুনাফার সঙ্গে মজুরীর সম্পর্ক সংঞ্চায়িত করে, তখন সে পুঁজিপতিদের স্বার্থকেই শেষ কথা বলে ধরে নেয়। তার মানে তাকে যা ব্যাখ্যা করতে হবে বলে মনে করা হয় তা সে মেনে নেয়। একই ভাবে, সর্বক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা চলে আসে। একে ব্যাখ্যা করা হয় বাহ্যিক পরিস্থিতি হতে। যদ্দুর পর্যন্ত এই সব বাহ্যিক ও আকস্মিক প্রতীয়মান পরিস্থিতি বিকাশের একটি প্রামাণিক পর্যায়ের প্রকাশ ছাড়া কিছুই না, তদ্দুর পর্যন্ত রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র আমাদের কিছুই শেখায় না। আমরা দেখেছি কেমন করে খোদ বিনিময় এর কাছে একটি আকস্মিক বাস্তবতা বলে প্রতিভাসিত হয়। রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র একটা চাকাই ঘুরিয়ে দিয়েছে, তা হল লোভ আর লোভীদের মাঝের যুদ্ধ- ভদ্র ভাষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা।*
মোদ্দা কথায়, সঞ্চালনটি যে পথে সংযুক্ত রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র তা ধারণ করেনা বলে কিছু কিছু ঠোকাঠুকি লাগা সম্ভব ছিল; যেমন, প্রতিযোগিতা তত্ত্বের সঙ্গে মনোপলি তত্ত্বের, কারু-শিল্পের স্বাধীনতা তত্ত্বের সাথে গিল্ড তত্ত্বের, ভূ-গত সম্পত্তির বিভাজন তত্ত্বের সাথে বড় ভূ-সম্পদ তত্ত্বের- প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে, কারু শিল্পের স্বাধীনতা এবং ভূ-গত সম্পত্তির বিভাজন ব্যাখ্যার মাঝে। এ সমস্ত কিছুকে বোধ করা হয়েছিল কেবল মনোপলি, গিল্ড ব্যবস্থা, সামন্ত সম্পত্তির আকস্মিক, পূর্ব অনুধ্যানকৃত এবং ভয়াবহ ফলাফল হিসেবে, তাদের প্রামাণিক, অনিবার্য এবং স্বাভাবিক ফলাফল হিসেবে নয়।
তাই এখন আমাদেরকে ব্যক্তিসম্পত্তি, লোভ, শ্রমের পৃথকীকরণ, পুঁজি এবং ভূ-গত সম্পত্তির মাঝের আসল সংযোগ; বিনিময় এবং প্রতিযোগিতা, মূল্য এবং মানুষের অবমূল্যায়ন, মনোপলি এবং প্রতিযোগিতা ইত্যাদির সংযোগ- এই সামগ্রিক বিচ্ছিন্নতা এবং অর্থ ব্যবস্থার মাঝের সংযোগ বুঝতে হবে।
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রীরা যেমন গল্পগাছার মত আদিকালিক অবস্থায় গিয়ে পড়েন, আমরা যেন তেমনি করে পিছন দিকে না যাই। এরকম আদিকালিক অবস্থা কিছুই ব্যাখ্যা করেনা; তা কেবল প্রশ্নগুলোকে ঠেলে সরিয়ে দেয় ধূসর নীহারিকাময় দূরত্বে। অর্থনীতিবিদ তার ধারণাগুলো দাঁড় করান একটা তথ্য, ঘটনা, আর তিনি যা বের করে আনবেন বলে মনে করেন তার আদলে। সেই বের করা মানে- বলতে গেলে, দুটো জিনিসের মাঝের প্রামাণিক সম্পর্ক- যেমন আছে শ্রম বিভাজন এবং বিনিময়ের মাঝে। এমনি করে ধর্মতাত্ত্বিক স্বর্গ হতে মানুষের পতন দিয়ে অশুভের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেন; তার মানে তাকে যা ব্যাখ্যা করতে হবে তা তিনি ঐতিহাসিক আঙ্গিকে একটি বাস্তবতা বলে ধরে নেন।
আমরা যাত্রা শুরু করেছি একটা বাস্তব অর্থনৈতিক তথ্য হতে।
শ্রমিক যত সম্পদ উৎপাদন করে, তার উৎপাদন-ক্ষমতা এবং আকারে যত বাড়ে সে ততই দরিদ্র হয়। সে যত বেশি পণ্য উৎপন্ন করে নিজে তত বেশি সস্তা পণ্যে পরিণত হয়। মানুষের জগতের অবমূল্যায়ন সরাসরি জিনিসের জগতের ক্রমবর্ধমান মূল্যের অনুপাতে চলে। শ্রম শুধু পণ্যই উৎপন্ন করে না, তা নিজেকে এবং শ্রমিককেও একটা পণ্য হিসেবে উৎপাদন করে- আর তা সাধারণভাবে শ্রমের উৎপন্ন পণ্যের সমান তালে চলে।
এই তথ্যটি অন্তত এটুকু প্রকাশ করে যে, শ্রম উৎপাদিত বিষয়- শ্রমের উৎপন্ন- বিজাতীয় একটা কিছু হিসেবে এর মুখোমুখি হয়, মুখোমুখি হয় উৎপাদনকারী হতে স্বাধীন একটা ক্ষমতা হিসেবে। শ্রমের উৎপন্ন হল কোন বিষয়ে রূপায়িত হওয়া শ্রম, এমন শ্রম যা বস্তুগত হয়েছে : এটা হল শ্রমের বিষয়করণ । শ্রমের উপলব্ধি করা হল এর বিষয়করণ। এই সব অর্থনৈতিক শর্তের অধীনে শ্রমের এই উপলব্ধিকরণ শ্রমিকদের জন্য উপলব্ধিহীনতা হিসেবে প্রতিভাসিত হয়;(১) বিষয়করণ প্রতিভাসিত হয় বিষয়হীনতা এবং বিষয়ের বন্ধন হিসেবে; অধিকার করা প্রতিভাসিত হয় বিচ্ছিন্নতা হিসেবে, বিজাতীয়তা হিসেবে।(২)
শ্রমের উপলব্ধি এতটাই উপলব্ধিহীনতা হিসেবে আবির্ভূত হয় যে, শ্রমিকের উপলব্ধিহীনতা অনাহারে মৃত্যুর বিন্দুতে পৌঁছয়। বিষয়করণ এতটাই বিষয়হীনতা হিসেবে আবির্ভূত হয় যে, শ্রমিকের জীবন ধারণের- এমনকি তার কাজের জন্য আবশ্যকীয় ন্যূনতম জিনিসগুলোও তার থেকে লুন্ঠিত হয়। আদতেই, শ্রম নিজেই এমন একটা বিষয় হয়ে পড়ে যা শ্রমিক পেতে পারে কেবল সর্বোচ্চ চেষ্টা চরিত্র আর চূড়ান্ত অনিয়মিত বিঘ্নের মাঝ দিয়েই। বিষয়ের অধিকারকরণ এতটাই বিচ্ছিন্নতা হিসেবে প্রতিভাসিত হয় যে, শ্রমিক যত বেশি বিষয় উৎপন্ন করে ততই কম সে দখলে রাখতে পারে, আর তত বেশি সে তলিয়ে যায় নিজের উৎপাদন মানে পুঁজির পাকে।
শ্রমিক তার শ্রমের উৎপন্নঞ্চর সঙ্গে একটা বিজাতীয় বিষয় হিসেবে সম্পর্কিত- এই বক্তব্যটি, আমরা এতক্ষণ যে ফলাফলের কথা বললাম তার ইঙ্গিত বহন করছে। এই প্রাক-সিদ্ধান্ততে এটা পরিষ্কার যে, শ্রমিক নিজেকে যত খরচ করে ফেলে, বিষয়ের বিজাতীয় জগত ততই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যে জগত সে নিজের ওপর নিজেরই বিরুদ্ধে সৃষ্টি করেছে। শ্রমিক যত দরিদ্র হয়- তার ভেতরকার জগতটার নিজের মত করে অধিকার সে ততই হারাতে থাকে। ধর্মের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম। মানুষ যত বেশি ঈশ্বরের ওপর আরোপ করে, তার নিজের মাঝে থাকা জিনিসের দখল তত কমে। শ্রমিক বিষয়ের মধ্যে নিজের জীবনটা দিয়ে দেয়; আর তারপর তার জীবন আর নিজের থাকেনা, হয়ে যায় বিষয়ের জীবন।
এমনি করে, এই ক্রিয়াকান্ড যত বড় হয়, শ্রমিক তত বিষয়হারা হয়ে ওঠে। তার শ্রমের উৎপাদ আর যাই হোক- সে নিজে তো নয়। অতএব যত বড় উৎপন্ন, সে নিজে তত ক্ষুদ্র। তার উৎপন্নের মধ্যে শ্রমিকের বিজাতীয়তা শুধু এই বোঝায় না যে তার শ্রম একটি বিষয়, একটা বাহ্যিক অস্তিত্ব হয়ে যায়, বরং এও বোঝায় যে, এটি তার বাইরে স্বাধীনভাবে অস্তিত্বমান থাকে তার প্রতি বিজাতীয় কিছু একটা হিসেবে। আরো বোঝা যায় যে, এটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে শ্রমিকের মুখোমুখি হয়। এর মানে তাহলে এই হয়, যে বিষয়কে সে জীবন দান করলো তা শত্রু হয়ে বিজাতীয় বেশে তারই বিরুদ্ধে মুখোমুখি হল।
এবার বিষয়করণ, শ্রমিকের উৎপাদন আর এসবের মাঝে বিচ্ছিন্নতা, বিষয় হারানো, তার উৎপন্নঞ্চর দিকে আরো ভালোভাবে খতিয়ে দেখবো।
প্রকৃতি ছাড়া, সংবেদনগত বাহ্যিক জগত ছাড়া শ্রমিক কিছুই তৈরী করতে পারেনা। বস্তুর ওপরেই শ্রম উপলব্ধ হয়, এতেই শ্রম সক্রিয় হয়, এটি হতে এবং এর উপায়েই উৎপাদন করে।
কিন্তু প্রকৃতি ঠিক যেমন শ্রমকে জীবন ধারণের উপায় (টি) যোগান দেয় এই দৃষ্টিতে যে, যে বিষয়ে শ্রম চালিত হবে তা ছাড়া সে বাঁচতে পারেনা, অপরদিকে এটা আরো সংকীর্ণ দৃষ্টিতে জীবন ধারণের উপায় সরবরাহ করে, যার মানে শ্রমিকের নিজের শারীরিক সংস্থানের জন্য খাওয়া পরা।
এভাবে শ্রমিক তার শ্রম দিয়ে বাহ্যিক জগত, সংবেদনগত প্রকৃতি যত ঠিকঠাক করে, ততই সে দুই ভাবে নিজেকে জীবন ধারণের উপায় থেকে বঞ্চিত করে : প্রথমত, এতে সংবেদনগত বাহ্যিক জগত তার শ্রমের অধিকারভুক্ত বিষয় হিসেবে- তার শ্রমের বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে ক্রমাগত কম দখলে থাকতে শুরু করে; আর দ্বিতীয়ত, প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে এটি শ্রমিকের জীবন ধারণের, শারীরিক সংস্থানের উপায় থেকে দূরে ঠেলে দেয়।
দুভাবেই তাই শ্রমিক তার বিষয়ের দাস হয়ে পড়ে। প্রথমত, এতে সে শ্রমের একটি বিষয় লাভ করে, মানে এতে সে কাজ পায়; দ্বিতীয়ত, এতে সে বেঁচে বর্তে থাকার উপায় পায়। এটা তাকে টিকে থাকতে সক্ষম করে। প্রথমত, শ্রমিক হয়ে- একটা শরীরি বিষয়ী হিসেবে। এই দাসত্ব শৃঙ্খলের চূড়ান্ত হলো এই যে, কেবলমাত্র শ্রমিক হিসেবে সে নিজেকে শরীরি বিষয়ী হিসেবে টিকিয়ে রাখতে পারে, আর শুধুমাত্র শরীরি বিষয়ী হিসেবে সে একজন শ্রমিক।
(অর্থশাস্ত্রের বিধি অনুসারে বিষয়ের মধ্যে শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতা এই ভাবে প্রকাশ পায় : শ্রমিক যত বেশি উৎপাদন করে তত কম তাকে ভোগ করতে হয়। যত অধিক মূল্য সে সৃষ্টি করে, ততই অর্থহীন, ততই অকেজো হয়ে পড়ে সে নিজে। উৎপাদিত পণ্য যত উৎকৃষ্ট আকার পায়, সে হয়ে ওঠে ততই আকারহীন; বিষয় যত সভ্য, শ্রমিক তত বর্বর হয়ে ওঠে। শ্রম যত ক্ষমতাশীল ততই ক্ষমতাহীন হয় শ্রমিক; শ্রম যত কৌশলী হয়, ততই অকৌশলী হয়ে ওঠে শ্রমিক আর ততই সে হয়ে পড়ে প্রকৃতির দাস)।
রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র শ্রমের স্বভাবের ভেতর নিহিত বিচ্ছিন্নতাকে ছদ্মবেশ পরিয়ে দেয়। আর তা করে শ্রমিক (শ্রম) এবং উৎপাদনের মধ্যকার সম্পর্ককে সরাসরি বিচার না করে। এটা সত্য যে, শ্রম ধনীর জন্য বিস্ময়কর সব জিনিস উৎপাদন করে- কিন্তু শ্রমিকের জন্য সে উৎপাদন করে বঞ্চনা। প্রাসাদোপম অ-ালিকা সে তৈরী করে, অথচ তার নিজের জায়গা হয় জরাজীর্ণ বস্তিতে। সৌন্দর্য উৎপাদন করে শ্রমিকের ভাগে পড়ে কদর্যতা। সে যন্ত্র দিয়ে শ্রমকে প্রতিস্থাপন করে, কিন্তু তা করতে গিয়ে শ্রমিকদের একাংশ ফিরে যায় বর্বর ধরণের শ্রমে, আরেকটা অংশ যন্ত্রে পরিণত হয়। বুদ্ধিমত্তার উৎপাদন করে শ্রমিকদের ভাগে পড়ে মূঢ়তা, মানসিক বিকলাঙ্গতা।
শ্রমের সঙ্গে শ্রমের উৎপন্নঞ্চর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক হলো শ্রমিকের সাথে তার উৎপাদনের বিষয়ের সম্পর্ক। গায়ে খাটা মানুষের সাথে উৎপাদনের বিষয় এবং খোদ উৎপাদনের সম্পর্ক কেবল প্রথম সম্পর্কের ফলাফল এবং এর নিশ্চয়তার বিধায়ক। আমরা এই অন্যদিকটা পরে খতিয়ে দেখব। তাই যখন আমরা জানতে চাই শ্রমের প্রামাণিক সম্পর্ক কি- আমরা আসলে জানতে চাচ্ছি শ্রমিকের সাথে উৎপাদনের সম্পর্কটা কি।
এখন পর্যন্ত আমরা শ্রমিকের বিচ্ছিন্নতার বিজাতীয়তার বিচার করে এসেছি এর একটা মাত্র দিক দিয়ে, তার মানে, শ্রমিকের সাথে তার শ্রমের উৎপন্নঞ্চর সম্পর্কে । কিন্তু এ বিচ্ছিন্নতা শুধু ফলাফলেই নয়, বরং উৎপাদন ক্রিয়াতে, খোদ উৎপাদনের ক্রিয়াকলাপেও প্রকাশিত হয়। শ্রমিকেরা কেমন করে আগন্তুকের মতো তার ক্রিয়াকলাপের উৎপন্নঞ্চর মুখোমুখি হয়? উৎপাদনের ক্রিয়াতেই সে কি নিজেকে নিজের সাথে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে না?
সর্বোপরি উৎপন্ন হলো ক্রিয়াকলাপের, উৎপাদনের সার-সংক্ষেপ। তাহলে শ্রমের উৎপন্ন যদি হয় বিজাতীয়তা, উৎপাদন নিজে অবশ্যই সক্রিয় বিজাতীয়তা, ক্রিয়াকলাপের বিজাতীয়তা, বিজাতীয়তার ক্রিয়াকলাপ। শ্রমের এই বিষয় বিচ্ছিন্নতা স্বয়ং শ্রমের ক্রিয়াকান্ডে বিচ্ছিন্নতা বিজাতীয়তাকে সার-সংক্ষেপিত করে।
তাহলে কোন জিনিসটা শ্রমের এই বিচ্ছিন্নতা গঠন করে? প্রথমত বলা যায়, শ্রম শ্রমিকের কাছে বাইরের জিনিস; তার মানে শ্রম তার স্বভাবগত কোন আচরণ থাকে না। কাজের মধ্যে তাই শ্রমিক নিজেকে স্বীকৃতির বদলে অস্বীকৃতিই জানায়, তৃপ্তির বদলে অতৃপ্তি বোধ করে, দৈহিক ও মানসিক শক্তির সুূষ্ঠু ও স্বাধীন বিকাশ তো দূরের কথা, দেহ মনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। শ্রমিক তাই নিজেকে তার কাজের বাইরে বলে অনুভব করে; আবার কাজের ক্ষেত্রে কাজটাকে অনুভব করে নিজের বাইরে বলে। যতক্ষণ সে কাজ করেনা ততক্ষণ সে স্বস্তিবোধ করে; আর যখন সে কাজ করে তখন সে স্বস্তি হারায়। তাই তার শ্রম স্বেচ্ছাকৃত নয়, বরং জবরদস্তিমূলক। এই শ্রম তাই কোন অভাবের তৃপ্তিসাধন নয়; বরং নিছক তার বাইরের কোন অভাব মেটাবার উপায় মাত্র। শ্রমের এই বিচ্ছিন্ন চরিত্রের প্রকাশ ঘটে যখন দেখা যায় যে, কোন রকম বাস্তব চাপ প্রয়োগ না করলে শ্রমের প্রবাহে ভাটা পড়ে। বাহ্যিক শ্রম- (যে শ্রমে মানুষ নিজেকে বিজাতীয় করে ফেলে) শ্রমিকের একধরণের আত্ম উৎসর্গ, শ্রমের পচনশীলতা। সবশেষে শ্রমের এই বাহ্যিক চরিত্র শ্রমিকদের জন্য এতেই প্রতীয়মান হয় যে এটি তার নিজের নয়, অন্য কারো। এ শ্রম তার দখলে নয়, বরং সে নিজেই শ্রমের দখলে; সে শ্রম নিজের জন্য নয়- অন্য কারো জন্য। ঠিক এমনি করেই মানব মস্তিস্ক মানব হৃদয়ের, মানবিক কল্পনার স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়াকলাপ স্বতন্ত্রের থেকে স্বাধীন হয়ে স্বতন্ত্রের মাঝে চালিত হয়। তার মানে তা চালিত হয় বিজাতীয়, দেবসুলভ অথবা শয়তান সুলভ ক্রিয়াকলাপ রূপে। তেমনি করেই শ্রমিকের এই ক্রিয়াকলাপও তার স্বতঃস্ফূর্ত কিছু নয়। এসবই অন্য কারো শর্তাধীন, নিজকে হারিয়ে ফেলার ক্রিয়াকলাপ।
ফল হিসেবে তাই মানুষ (শ্রমিক) নিজেকে স্বাধীনভাবে সক্রিয় ভাবতে পারে তার জান্তব কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে- খাওয়াদাওয়া, বংশ বিস্তার অথবা খুব বেশি হলে বাস এবং বেশভূষার ব্যাপারে। মানবীয় কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় থেকে নিজেকে সে পশুর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারে না। যা কিছু জান্তব তা-ই মানুষের, যা কিছু মানবিক তা-ই জান্তব।
নিশ্চই খাদ্যগ্রহণ, প্রজনন এসবও প্রকৃত অর্থে মানবীয় কর্মকান্ড। কিন্তু অমূর্ত দৃষ্টিকোণ হতে মানুষের অন্যসব ক্রিয়াশীলতার ক্ষেত্র হতে, স্বতন্ত্রভাবে যদি শেষ অবধি একমাত্র এই বিষয়গুলি মুখ্য হয়, তবে এগুলো পশুবৃত্তির বেশি কিছু হতে পারে না।
আমরা শ্রম, মানুষের হাতে কলমের ক্রিয়াকান্ডের বিচ্ছিন্নতার কাজটিকে এর দুটি দৃষ্টিকোণ হতে বিবেচনা করেছি। (১) শ্রমিকের সঙ্গে তার শ্রমের উৎপন্নঞ্চর সম্বন্ধের প্রেক্ষিতে, যে উৎপন্ন একটা বিচ্ছিন্ন শক্তি হয়ে তার উপর খবরদারি করে। একই সঙ্গে এই সম্বন্ধ সংবেদনগত বহির্জগত এবং প্রকৃতির বস্তুজগতের সঙ্গে তার সম্পর্ক নির্দেশ করে- যে জগত তার সম্মুখে আবির্ভূত হয় বৈরী এক বিরুদ্ধ জগত হয়ে। (২) শ্রমের কার্য পরম্পরায় শ্রমের সঙ্গে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সম্পর্ক। এটা হচ্ছে বিজাতীয় ক্রিয়াকান্ড হিসেবে শ্রমিকের সঙ্গে তার নিজস্ব ক্রিয়াকান্ডের সম্পর্ক, যা তার নিজের নয়। এই ক্রিয়াকান্ড হল দূর্ভোগ, দূর্বলতা হিসেবে শক্তি, জন্ম দিতে গিয়ে খোজা হয়ে যাওয়া। এতে নিজের শারীরিক এবং মানসিক শক্তি, তার ব্যক্তি জীবন, সব দিতে হয়- কারণ ক্রিয়াকান্ড ছাড়া জীবন আর কি?- যে ক্রিয়াকান্ড তার বিরুদ্ধেই ঘুরে দাঁড়ায়, তার তোয়াক্কা করেনা, তার দখলে থাকেনা। এখানে আমরা পাচ্ছি আত্ম-বিচ্ছিন্নতা, যেমন আগে পেয়েছি জিনিসের বিচ্ছিন্নতা।
এ পর্যন্ত যে দুটো প্রেক্ষিত আমরা বিচার করলাম তার থেকেই বের করা বিচ্ছিন্ন শ্রমের আরো তৃতীয় একটা প্রেক্ষিত রয়ে গেছে।
মানুষ একটি প্রজাতি সত্তা;(৩) তা শুধু এজন্য নয় যে হাতে কলমে এবং তত্ত্বে সে তার বিষয় হিসেবে প্রজাতিটিকে গ্রহণ করে (তার নিজের এবং একই সঙ্গে অন্যান্য জিনিসেরও),- বা এটি একে প্রকাশ করার আরেকটি পথ মাত্র। বরং একারণেও যে সে হচ্ছে সেই প্রজাতি সত্তা যে নিজেকে দেখে বাস্তব, জীবন্ত প্রজাতি হিসেবে, আরো কারণ সে নিজেকে দেখে সার্বিক আর তাই একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে।
মানুষ ও পশু উভয় প্রজাতির জীবন এই বাস্তবতায় শরীরবৃত্তিকভাবে স্থিত যে, মানুষ (পশুর মতোই) অজৈব প্রকৃতিতে বেঁচে থাকে, এবং মানুষ (অথবা পশু) যত সার্বিক, যাতে সে বাঁেচ সেই অজৈব প্রকৃতির বলয়ও ততই সার্বিক। ঠিক যেমন করে পশুজগত, গাছ পাথর, আলো, বাতাস তত্ত্বগতভাবে মানব চৈতন্যের অংশবিশেষ গঠনে অবদান রাখে- অংশত প্রকৃতি বিঞ্চানের বিষয় হিসেবে, অংশত শিল্পকলা হিসেবে (অর্থাৎ তার মরমগত অজৈব প্রকৃতি, মরমগত পরিপুষ্টি) যাকে তার অবশ্যই প্রথমত রুচিকর ও সুপাচ্য বস্তুতে পরিণত করতে হয়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে; কেননা তা মানুষের জীবন ও ক্রিয়াশীলতার অন্যতম অংশ গঠন করে। শরীরবৃত্তিকভাবে মানুষ কেবল প্রকৃতির এসব উৎপন্নঞ্চর উপরই বাঁচে, তা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, তাপ ইত্যাদি যে রূপেই এরা আবির্ভূত হোক না কেন! প্রায়োগিক ক্ষেত্রে মানুষের সার্বিকতা আবির্ভূত হয় ঠিক সেই সার্বিকতার মধ্য দিয়ে, যা সমস্ত প্রকৃতিকে তার অজৈব শরীরে পরিণত করে- ঠিক যতটা প্রকৃতি (১) তার জীবনধারণের সরাসরি উপায় এবং (২) তার জীবনের ক্রিয়াশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় বস্তু, বিষয় ও উপকরণ। প্রকৃতিই মানুষের অজৈব শরীর, মানে প্রকৃতি, যতটা নিজেই মানুষের শরীর নয় ততটুকু। মানুষ প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বাঁচে- তার মানে প্রকৃতি মানুষের এমন শরীর যার সাহায্যে তাকে অবিরত পারস্পরিক আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া চালু রাখতে হয় যদি তাকে মরতে না হয়। মানুষের শরীরবৃত্তিক জীবন ও আত্মিক জীবন প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ কথার সাধারণ অর্থ এই যে, যেহেতু মানুষ প্রকৃতিরই একটা অংশ সেহেতু প্রকৃতি নিজের সাথেই সম্পর্কিত।
মানুষের সঙ্গে (১) প্রকৃতির এবং (২) তার নিজস্ব সক্রিয় কর্মকান্ড, বিচ্ছিন্ন শ্রমের বিচ্ছিন্নকরণ মানুষকে তার প্রজাতি হতে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। এটি তার জন্য প্রজাতির জীবনকে স্বতন্ত্র জীবনের উপায়ে বদলে ফেলে। প্রথমত, এটি প্রজাতির জীবন এবং স্বতন্ত্র জীবনকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে; দ্বিতীয়ত, এটি এর অমূর্ত আঙ্গিকে স্বতন্ত্র জীবনকে তৈরী করে প্রজাতির জীবনের উদ্দেশ্য রূপে।
শ্রমের ক্ষেত্রে, জীবন ক্রিয়া- খোদ উৎপাদনশীল জীবন মানুষের নিকট আবির্ভূত হয় প্রথমে নিছক একটি চাহিদা পূরণের উপায় হিসেবে, খাওয়াপরা চালানোর চাহিদা হিসেবে, যদিও উৎপাদনশীল জীবনই হচ্ছে প্রজাতির জীবন। এটি জীবন সঞ্চারী জীবন। একটি প্রজাতির সামগ্রিক চরিত্র (তার প্রজাতি চরিত্র) তার জীবনের ক্রিয়াশীলতার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিহিত; আর স্বাধীন সচেতন ক্রিয়াই মানুষের প্রজাতি চরিত্র। জীবন নিজেই আবির্ভূত হয় কেবল জীবন ধারণের উপায় হয়ে।
পশুজগতে দেখা যায়- তাদের জীবন ক্রিয়া তাদের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। পশুরা তাদের জীবন ক্রিয়া হতে নিজেদের পৃথক করে না। এটাই তাদের জীবন ক্রিয়া । মানুষ তার জীবন ক্রিয়াকে গড়ে নেয় তার ইচ্ছা ও চৈতন্যের বিষয় হিসেবে। তার রয়েছে চৈতন্যগত জীবন ক্রিয়া। এটা এমন কোন নির্ধারণ নয় যার সাথে সে নিমজ্জিত হবে। সচেতন জীবন ক্রিয়া মানুষকে প্রত্যক্ষরূপে পশুর জীবন ক্রিয়া হতে পৃথক করে স্রেফ এজন্য যে, মানুষ হচ্ছে প্রজাতি সত্তা। অথবা এটা শুধুই এজন্য যে, প্রজাতি সত্তা বলেই সে চেতন সত্তা, তার মানে তার নিজস্ব জীবন তার জন্য একটা বিষয়। তা শুধুমাত্র এই কারণে যে, তার ক্রিয়া হচ্ছে স্বাধীন ক্রিয়া। বিচ্ছিন্ন শ্রম এই সম্পর্কটাকে উল্টে ফেলে। ফলে মানুষ শুধুমাত্র একটা চৈতন্য সত্তা বলেই সে তার জীবন ক্রিয়া, প্রামাণিক সত্তাকে তার অস্তিত্ব রক্ষার নিছক একটা উপায় বানিয়ে ফেলে।
মানুষ তার প্রায়োগিক ক্রিয়াশীলতা দ্বারা বিষয়এর জগত সৃষ্টির কালে, অজৈব প্রকৃতির দিকে তার কাজে নিজেকে প্রমাণ করে চৈতন্যশীল প্রজাতি সত্তা হিসেবে। তার মানে এমন একটি সত্তা যা প্রজাতিসমূহকে নিজের প্রামাণিক সত্তারূপে বিবেচনা করে, কিংবা নিজেকে একটি প্রজাতি সত্তা হিসেবে বিবেচনা করে। এটা স্বীকৃত যে, অন্য প্রাণীরাও উৎপাদন করে। তারা নিজেদের বাসা, বাসস্থান তৈরী করে। কিন্তু প্রাণীরা শুধুমাত্র তা-ই উৎপন্ন করে যা তাদের নিজেদের এবং শাবকদের প্রত্যক্ষ চাহিদাগুলো মেটাবার জন্য প্রয়োজন। তাদের এই উৎপাদন একপেশে, অপরদিকে মানুষের উৎপাদন সার্বিক। পশুর উৎপাদন শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ দৈহিক চাহিদার বশবর্তী ফল। অপরদিকে মানুষের উৎপাদন শরীরবৃত্তিক চাহিদামুক্ত সময়েও অব্যাহত থাকে। বাস্তবিকই তা হতে স্বাধীন উৎপাদনই হচ্ছে প্রকৃত উৎপাদন। পশুর একমাত্র উৎপাদন সে স্বয়ং, আর মানুষ প্রকৃতির সমস্তটাই পুনরুৎপাদিত করে। পশুর উৎপাদন প্রত্যক্ষভাবে তার ভৌতিক দেহের অধীন, যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে তার উৎপন্নঞ্চর মুখোমুখি দাঁড়ায়। প্রাণীরা গঠিত হয় কেবল তার প্রজাতির বৈশিষ্ট্য ও চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে। অন্যদিকে মানুষ জানে প্রতিটি প্রজাতির বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিভাবে উৎপাদন করতে হয় এবং কিভাবে সব বিষয়ে অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্যসমূহকে কাজে লাগাতে হয়। মানুষ তাই বিষয়ের গঠনও করে সৌন্দর্যের নীতি অনুসরণ করে।
কেবল বিষয় জগতে কাজের মধ্যেই মানুষ সত্যিকার অর্থে নিজেকে প্রমাণ করে প্রজাতি সত্তা হিসেবে। এই উৎপাদনই তার সক্রিয় প্রজাতি জীবন। এই উৎপাদনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি তার কাজ ও তার বাস্তবতা হিসেবে আবির্ভূত হয়। শ্রমের বিষয় তাই মানুষের প্রজাতি জীবনের বিষয়করণ : এটা এজন্যে যে, সে শুধু নিজেকে চৈতন্য, বৌদ্ধিকতার হিসেবেই প্রতিরূপিত করে না বরং সক্রিয়তায়, বাস্তবতাতেও প্রতিরূপিত করে। আর তাই সে নিজেকে দেখতে পায় এমন এক জগতে যা তার নিজের তৈরী। মানুষের কাছ থেকে তার উৎপাদনের বিষয়কে ছাড়িয়ে নেবার ফলে বিচ্ছিন্ন শ্রম তার কাছ থেকে তার প্রজাতি জীবনকে ছিন্ন করে, যা প্রজাতির একজন সদস্য হিসেবে তার বাস্তব বিষয়তা। এভাবে পশুজগতের মধ্যে তার উচ্চতর অবস্থান তার পক্ষে সুবিধার বদলে অসুবিধা হয়ে যায়, মানে তার অজৈব শরীর অর্থাৎ প্রকৃতি তার কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়।
একই ভাবে জীবিকার দায়ে স্বতঃস্ফূর্ত, মুক্ত ক্রিয়াকলাপ হতে অধঃপতিত হয়ে মানুষের বিচ্ছিন্ন শ্রম তার প্রজাতি জীবনকে শরীরবৃত্তিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উপায়ে পরিণত করে।তার প্রজাতির ব্যাপারে মানুষের যে চৈতন্য আছে তা এই ভাবে বিচ্ছিন্নতা কর্তৃক এমনভাবে রূপান্তরিত হয় যেন প্রজাতি (-জীবন) তার জন্য একটা জীবিকামাত্র। এভাবে বিচ্ছিন্ন শ্রম মোড় নেয় :
(৩) মানুষের প্রজাতি সত্তা, প্রকৃতি ও আত্মিক প্রজাতিসম্পদ উভয়েই পরিণত হয় বিজাতীয় সত্তায়, তার ব্যক্তিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার উপায় হিসেবে। এটা ততটাই মানুষকে তার নিজের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে যতটা বিচ্ছিন্ন করে তার বাহ্যিক প্রকৃতি এবং আত্মিক ও মানবিক প্রেক্ষাপট হতে।
(৪) মানুষ তার শ্রমের উৎপাদ হতে বিচ্ছিন্ন, বিচ্ছিন্ন তার জীবন ক্রিয়া হতে; বিচ্ছিন্ন প্রজাতি সত্তা হতে - এই সত্যতার প্রত্যক্ষ ফলাফল হচ্ছে মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের বিচ্ছিন্নতা। মানুষ যখন নিজের সম্মুখে দাঁড়ায়, তখন সে আসলে অন্য একটা মানুষের মুখোমুখি দাঁড়ায়। এই কথাটাই খাটে মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কে ক্ষেত্রে। একই কথা খাটে একটা মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের সম্পর্কের বেলায়, সেই মানুষের শ্রম ও শ্রমের বিষয়ের জায়গায়।
যখন বলা হয় মানুষের প্রজাতি স্বভাব তার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, তখন আসলে বোঝানো হয় যে প্রতিটি মানুষই অপরাপর মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন। যেমন করে তাদের প্রত্যেকেই মানুষের আবশ্যকীয় স্বভাব হতে বিচ্ছিন্ন।
তাই বিচ্ছিন্ন শ্রমের সম্পর্কের ভেতরে প্রত্যেক মানুষ অপর মানুষকে দেখে সেই মাপকাঠি এবং সম্পর্ক অনুসারে যাতে সে নিজেকে খুঁজে পায় একজন শ্রমিক হিসেবে।
এবার আরেকটু তলিয়ে দেখা যাক, কেমন করে বিচ্ছিন্ন বিজাতীয় শ্রমের ধারণা নিজেকে বাস্তব জীবনে অনিবার্যভাবে প্রকাশ করে। যদি শ্রমের উৎপন্ন আমার কাছে বিজাতীয় হয়, যদি সে আমার মুখোমুখি হয় বিজাতীয় ক্ষমতা হিসেবে - তাহলে সেই শক্তি কার সত্তাধীন?
যদি আমার ক্রিয়াকলাপ আমার না হয়, যদি তা হয় বিজাতীয়, জবরদস্তিমূলক ক্রিয়া; তাহলে এই ক্রিয়া কার সত্তাধীন?
আমি ছাড়া অন্য কোন সত্তার।
কে সেই সত্তা?
নিশ্চিত করে বলতে গেলে, আগের কালে প্রধান উৎপাদন (উদাহরণস্বরূপ মিশর, ভারত, মেক্সিকোতে মন্দির নির্মাণ ইত্যাদি) দেবতার সেবায় বলে প্রতীয়মান হত, আর উৎপাদনের মালিকানা ছিল দেবতাদের। যাই হোক, দেবতারা নিজেরা কখনোই শ্রমের প্রভু ছিলেন না, প্রকৃতিও নয়। এখানে কি আশ্চর্য একটা পরস্পরবিরোধিতা দেখা যেত, যদি মানুষ তার নিজের শ্রমে প্রকৃতিকে যতটা বশ করত, শিল্পের অলৌকিকতা দিয়ে দেবতাদের অলৌকিকতা ততই আজগুবি বলে বোঝা যেত। তখন আবার মানুষকে উৎপাদনের আনন্দ আর উৎপাদের উপভোগ ততই খারিজ করতে হতো দেবতাদের শক্তিকে তোয়াজ করার জন্য।
সেই বিজাতীয় সত্তা, শ্রম এবং শ্রমের উৎপন্ন যার সত্তাধীন, যার সেবায় শ্রম সম্পাদন হয় আর যার উপকারের জন্য শ্রমের উৎপাদ সরবরাহ করা হয় সে কেবল মানুষই হতে পারে।
যদি শ্রমের উৎপন্ন শ্রমিকের সত্তাধীন না হয়, যদি তা একটি বিজাতীয় সত্তা হিসেবে শ্রমিকের মুখোমুখি দাঁড়ায় তাহলে একটাই কারণ হতে পারে। কারণটা হলো এটি শ্রমিক ছাড়া অন্য কোন মানুষের সত্তাধীন। যদি শ্রমিকের ক্রিয়া তার জন্য যন্ত্রণাদায়ক হয়, সেই জন্য অন্য কাউকে নিশ্চয়ই সে তৃপ্তি এবং আনন্দ দেয়। দেবতা নয়, প্রকৃতি নয়, কেবল মানুষই হতে পারে মানুষের ওপর খবরদারী করা সেই বিজাতীয় শক্তি। আমাদের পূর্বতন প্রস্তাবনা কোনমতেই ভুলে যাওয়া চলবে না। প্রস্তাবনাটি হলো, মানুষের নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক বিষয়মুখ এবং বাস্তব হয়ে উঠতে পারে কেবল অন্য মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্কের মাধ্যমে। এভাবে যদি তার শ্রমের উৎপন্ন, তার বিষয়কৃত শ্রম, তার জন্য একটা বিজাতীয়, শত্রুভাবাপন্ন, তার হতে স্বাধীন ক্ষমতাশীল বিষয় হয়, তাহলে এর প্রতি তার অবস্থান হয় এমন- যেন তার বিষয়ের মালিক অন্য কেউ, যে অন্য কেউ তার থেকে স্বাধীন, বিজাতীয় শত্রুভাবাপন্ন এবং ক্ষমতাবান। যদি সে তার নিজের ক্রিয়াকে স্বাধীনতাহীন ক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে সে একে বিবেচনা করবে এমন একটি ক্রিয়া হিসেবে যা অন্য মানুষের সেবায়, অধীনে, জবরদস্তিতে এবং অন্য মানুষের জোয়ালের নিচে সমাধিত।
নিজের এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের প্রতিটি আত্ম-বিচ্ছিন্নতা সেই সম্পর্কের মধ্যে প্রতিভাত হয়, যে সম্পর্কে সে নিজেকে এবং প্রকৃতিকে স্থাপন করে অন্য কোন আর তার থেকে ভিন্নতা সম্পন্ন কোন মানুষে। এই কারণে ধর্মীয় আত্ম-বিচ্ছিন্নতা প্রামাণিকভাবে আম-জনতার সঙ্গে ধর্মযাজকের অথবা আবার তাদের সঙ্গে মুর্শিদের সম্পর্কে প্রতিভাত হয়। আমরা যেহেতু বৌদ্ধিক জগত নিয়ে নাড়াচাড়া করছি তাই এ কথাটা বলা হলো। বাস্তবে হাতে-কলমের জগতে আত্ম-বিচ্ছিন্নতা প্রকাশিত হতে পারে কেবল অন্যান্য মানুষের সঙ্গে হাতে-কলমের সম্পর্কের মাধ্যমে। যে মাধ্যম দিয়ে বিচ্ছিন্নতা স্থান নেয় তা নিজেই প্রায়োগিক । এভাবে বিচ্ছিন্ন শ্রমের মাধ্যমে তার প্রতি বিজাতীয় এবং শত্রুভাবাপন্ন ক্ষমতার মত, বিষয় এবং উৎপাদনকার্যের প্রতি তার সম্পর্কই গড়ে তোলে না; এতে সে সেই সম্পর্কও সৃষ্টি করে যাতে অন্য মানুষ তার উৎপাদন এবং উৎপন্নের প্রতি অবস্থান নেয়। ঠিক যেমন করে সে তার উৎপাদনকে সৃষ্টি করে তার বাস্তবহীনতা হিসেবে, তাকে দেয়া শাস্তি হিসেবে। তার নিজের উৎপন্নকে সে এমন একটা ক্ষতি হিসেবে, এমন একটা উৎপন্ন হিসেবে দেখে যা তার সত্তাধীন নয়। ঠিক তেমনি করেই সে তৈরী করে সেই সব ব্যক্তিদের আধিপত্য- যারা উৎপাদন এবং উৎপন্নের উপর উৎপাদন করেনা। ঠিক যেমন করে সে নিজের থেকে তার নিজের ক্রিয়া বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, ঠিক তেমন একটা ক্রিয়া সে আরোপ করে সেই আগন্তুকের উপর যা তার নিজের নয়। এখন পর্যন্ত আমরা এ সম্পর্কটাকে শ্রমিকদের অবস্থান বিন্দু থেকে বিবেচনা করেছি, পরে আমরা একে অ-শ্রমিকদের অবস্থান বিন্দু থেকেও বিবেচনা করব। তাহলে বিচ্ছিন্ন, বিজাতীয় শ্রমের মাধ্যমে শ্রমিক এই শ্রমের সঙ্গে এমন মানুষের সম্পর্ক তৈরী করে যে মানুষ শ্রমের প্রতি বিজাতীয় এবং যে এর বাইরে অবস্থান করে। শ্রমের প্রতি শ্রমিকের সম্পর্কটি শ্রমের প্রতি পুঁজিপতির (পুঁজিপতি অথবা শ্রমের মালিককে যে যে নামে ডাকতে চায় তার) সম্পর্কটি তৈরী করে । এমনি করে ব্যক্তি সম্পত্তি হলো বিজাতীয় শ্রমের, প্রকৃতি এবং তার নিজের সঙ্গে শ্রমিকের বাহ্যিক সম্পর্কের উৎপন্ন ফলাফল, প্রামাণিক ফল।
এমনি করে ব্যক্তি সম্পত্তি হতে বের হয়ে আসে বিজাতীয় শ্রমের ধারণা, তার মানে তা বের হয় বিজাতীয় মানুষের, বিচ্ছিন্ন শ্রমের, বিচ্ছিন্ন জীবনের, বিচ্ছিন্ন মানুষের বিশ্লেষণের ফল হিসেবে।
এটা সত্যি যে ব্যক্তি সম্পত্তি সঞ্চালনের ফল হিসেবেই আমরা রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রে বিজাতীয় শ্রমের ধারণা (বিজাতীয় জীবনের) লাভ করেছি। কিন্তু এ ধারণাটা বিশ্লেষণ করার পর এটা খোলাসা হয়ে গেল যে- যদিও ব্যক্তি সম্পত্তি বিজাতীয় শ্রমের যুক্তি, কারণ হিসেবে প্রতিভাত হয় আসলে তা এটির ফলাফল। ঠিক যেমন দেবতারা আসলে মানুষের বৌদ্ধিক সংশয়ের কারণ নয়, বরং প্রভাব। পরবর্তীতে এই সম্পর্ক হয়ে ওঠে পারস্পরিক।
বিকাশের চূড়ান্ত বিন্দুতেই কেবল ব্যক্তি সম্পত্তি এটা করে, তার গোপন কথা আবার ফাঁস হয়। বলতে গেলে এই যে, একদিকে তা বিচ্ছিন্ন শ্রমের উৎপন্ন আর অপরদিকে এটা হচ্ছে সেই উপায় যা দিয়ে শ্রম নিজেকে বিজাতীয় করে ফেলে, এ হল এই বিজাতীয়তার উপলব্ধি।
এই উন্মোচন সঙ্গে সঙ্গে এখন পর্যন্ত অসমাধিত অনেকগুলো ঠোকাঠুকিতে আলোকপাত করে।
(১) রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র শ্রমকে উৎপাদনের আসল আত্মা হিসেবে ধরে নিয়ে যাত্রা শুরু করে; যদিও শ্রমকে কিছুই না দিয়ে সব কিছুই দিয়ে বসে ব্যক্তি সম্পত্তিকে। এই পরস্পরবিরোধিতার মুখোমুখি হয়ে প্রুঁধো ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে শ্রমের পক্ষ নিয়েছিলেন(৪)। যা হোক, আমরা বুঝতে পারছি যে এই আগত পরস্পরবিরোধিতা হচ্ছে বিচ্ছিন্ন শ্রমের সঙ্গে এর নিজেরই বিরোধিতা, আর রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্র কেবল বিচ্ছিন্ন শ্রমের নিয়মগুলোকে সূত্রবদ্ধ করেছে।
অতঃপর আমরা আরো বুঝতে পারছি যে, মজুরী এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি অভিন্ন। আসলে উৎপন্ন যেখানে শ্রমের বিষয় হিসেবে খোদ শ্রমের জন্যই পাওনা মেটায়, সেখানে মজুরী শ্রমের বিচ্ছিন্নতার প্রামাণিক ফলাফল ছাড়া কিছু না। একই ভাবে শ্রমের মজুরীর ক্ষেত্রে শ্রম নিজেই নিজের পরিণতি না হয়ে বরং মজুরীর দাস হিসেবে প্রতিভাত হয়। আমরা এই ব্যাপারটি নিয়ে পরে বিশদ আলোচনা করব; এবং ইতিমধ্যে কেবল কয়েকটি উপসংহার টানব।
মজুরীর বলপূর্বক বৃদ্ধি(৫) (বাকি সব সমস্যা পাত্তা না দিয়ে; এমন একটা বিধি বহির্ভূত মজুরী বৃদ্ধি চালানো যাবে কিনা তা না ভেবে এটাও না হয় গ্রহণ করলাম) তাহলে দাসদের আরেকটু ভালো পাওনা মেটানো ছাড়া আর কিছু নয়, আর এতে শ্রমিক অথবা শ্রম কারোরই মানবিক অবস্থান এবং মর্যাদা জিতে নেয়া গেল না।
আসলে এমন কি মজুরীর সমতা (যেমনটি প্রুঁধো দাবি করেছিলেন), কেবল বর্তমানের শ্রমিকের সঙ্গে তার শ্রমের সর্ম্পককে বদলে ফেলে শ্রমের সঙ্গে সব মানুষের সম্পর্কে। সমাজকে তখন এক অমূর্ত পুঁজিপতি রূপে ধারণা করা হয়।
মজুরী হচ্ছে বিচ্ছিন্ন শ্রমের সরাসরি ফলাফল; আর বিচ্ছিন্ন শ্রম হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির সরাসরি কারণ। এদের একের পতন অবশ্যই তাই অন্যটির পতনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
(২) বিচ্ছিন্ন শ্রমের সঙ্গে ব্যক্তি সম্পত্তির সম্পর্ক হতে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে যে ব্যক্তি সম্পত্তি ইত্যাদির দাসত্ব থেকে সমাজের মুক্তি প্রকাশিত হয়েছে শ্রমিকদের মুক্তির রাজনৈতিক আঙ্গিকে। শ্রমিকদের মুক্তিই আবার শুধু ঝুঁকির মধ্যে আছে তা নয়, বরং কারণটা হল এই যে শ্রমিকদের মুক্তিই সার্বিক মানব মুক্তি ধারণ করে। তার কারণও আছে। কারণটা হল, সমগ্র মানব দাসত্ব উৎপাদনের সাথে শ্রমিকের সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট। আর দাসত্বের সব সম্পর্কই এই সম্পর্কের পরিশোধিত রূপ, ফলাফল মাত্র।
ঠিক যেভাবে আমরা বিচ্ছিন্ন, বিজাতীয় শ্রমের ধারণা হতে বিশ্লেষণ করে ব্যক্তি-সম্পত্তির ধারণা বের করে আনলাম, তেমন করে এই দুই সত্যতার সাহায্যে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের প্রত্যেকটি ক্যাটেগরি বিকশিত করতে পারি, আবার প্রতিটি ক্যাটেগরিতে (যেমন বাণিজ্য, প্রতিযোগিতা, পুঁজি, অর্থ) প্রথমোক্ত উপাদানগুলোরই একটা বিশেষ এবং বিকশিত প্রকাশ দেখতে পাব।
এই প্রপঞ্চ বিবেচনা করার আগে আরো দুটো সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা যাক। তা হলো:
(১) যেহেতু ব্যক্তি সম্পত্তি উঠে এসেছে বিচ্ছিন্ন শ্রমের ফল হিসেবে তাই সত্যিকারের মানব এবং সামাজিক সম্পত্তি হিসেবে ব্যক্তি সম্পত্তির সাধারণ স্বভাব সংঞ্চায়িত করা।
(২) আমরা শ্রমের বিচ্ছিন্নতা, এর বিজাতীয়তাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করেছি এবং এই সত্যকে বিশ্লেষণ করেছি। আমরা এখন জানতে চাই কিভাবে মানুষ তার শ্রমকে বিজাতীয়, বিচ্ছিন্ন করে ফেলে? আর কিভাবে এই বিচ্ছিন্নতা মানুষের বিকাশের প্রকৃতিতে শেকড় গেঁড়ে আছে? আমরা ইতিমধ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উৎপত্তির প্রশ্নটিকে বিজাতীয় শ্রমের সঙ্গে মানবতার বিকাশের পর্যায়ের সম্পর্কের প্রশ্নে রূপান্তরিত করার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানে অনেকদূর এগিয়ে গেছি। যখন কেউ ব্যক্তিগত সম্পত্তির কথা বলে তখন সে মানুষের বাইরের কিছু একটা নিয়ে নাড়াচাড়ার কথা ভাবে। যখন কেউ শ্রম নিয়ে কথা বলে, সে সরাসরি মানুষের নিজেকে নিয়েই নাড়াচাড়া করে। প্রশ্নটির এই নতুন সূত্রায়ন এর উত্তরটি ইতিমধ্যেই ধারণ করে নিয়েছে।
প্রথমটির ক্ষেত্রে : ব্যক্তি সম্পত্তির সাধারণ স্বভাব এবং আসল মানব সম্পত্তির সাথে এর সম্পর্ক।
বিজাতীয় শ্রম আমাদের জন্য নিজেকে পরস্পর নির্ভরশীল দুটি অংশে বিভক্ত করেছে, কিংবা এগুলো একই এবং অভিন্ন সম্পর্কের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। ঠিকঠাক করে অধিকার করাটা প্রতিভাত হয় বিচ্ছিন্নতা, বিজাতীয়তা হিসেবে; আর বিজাতীয়তা প্রতিভাত হয় ঠিকঠাক করে অধিকার করা হিসেবে, বিচ্ছিন্নতা সত্যিকারের নাগরিক হয়ে ওঠা হিসেবে।(৬)
আমরা একটি দিক বিবেচনা করেছি- শ্রমিকের নিজের সম্পর্কের সুবাদে বিজাতীয় শ্রম, তার মানে খোদ নিজের সাথেই বিজাতীয় শ্রমের সম্পর্ক। আমরা যেমন দেখেছি এই সম্পর্কের উৎপন্ন এই সম্পর্কের প্রামাণিক পরিণাম হচ্ছে অশ্রমিকদের শ্রমিক এবং শ্রমের সাথে সম্পত্তি সম্পর্ক । বিজাতীয় শ্রমের বস্তুগত সারসংক্ষেপিত প্রকাশ হিসেবে ব্যক্তি সম্পত্তি উভয় সম্পর্ককে ছুঁয়ে যায়- শ্রমিকের কাজ, তার শ্রমের উৎপন্ন এবং অশ্রমিকদের সাথে সম্পর্ক, আর শ্রমিক এবং তার শ্রমের উৎপন্নের সঙ্গে অশ্রমিকদের সম্পর্ক।
আমরা দেখতে পেলাম শ্রমিক তার শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতিকে ঠিকঠাক করে অধিকার করে, সেই ঠিকঠাক করাটা প্রতিভাত হয় বিচ্ছিন্নতা হিসেবে, তার স্বতঃস্ফূর্ত ক্রিয়া অন্যের জন্য এবং অন্যের ক্রিয়া হিসেবে, প্রাণশক্তি জীবন উৎসর্গ হিসেবে, বিষয়ের উৎপাদন একটি বিজাতীয় ক্ষমতা, একটি বিজাতীয় ব্যক্তির কাছে বিষয় হারিয়ে ফেলা হিসেবে। এইসবের সাপেক্ষে শ্রমিকের সম্পর্ক দেখার পর এই ব্যক্তি যে শ্রম এবং শ্রমিকের কাছে বিজাতীয়, তার সাথে শ্রমিকের সম্পর্কটি বিবেচনা করব। প্রথমেই খেয়াল রাখতে হবে শ্রমিকের মাঝে যা কিছু বিজাতীয়তার বিচ্ছিন্নতার ক্রিয়া হিসেবে প্রতিভাত হয় তা অশ্রমিকের কাছে একটি বিজাতীয়তা বিচ্ছিন্নতার দশা হিসেবে প্রতিভাত হয়।
দ্বিতীয়ত, শ্রমিকের উৎপাদন এবং উৎপন্নঞ্চর (মনের একটি দশা হিসেবে) মধ্যে বাস্তব প্রায়োগিক আচরণ অশ্রমিকদের মাঝে একটি তাত্ত্বিক আচরণ হিসেবে মুখোমুখি দাঁড়ায়।
তৃতীয়ত, শ্রমিক নিজের বিরুদ্ধে যা করে, অশ্রমিকও শ্রমিকের বিরুদ্ধে তা-ই করে; তবে অশ্রমিক শ্রমিকের বিরুদ্ধে যা করে, নিজের বিরুদ্ধে তা করে না।
এখন এই তিনটি সম্পর্ককে আরো খতিয়ে দেখা যাক।(ত)