Marxists Internet Archive
Bangla Section
অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া
কার্ল মার্কস
সম্পাদকের নোট
ক.
১৮৪৪ সালে কার্ল মার্ক্সের পারীবাস কালে লেখা অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া রচনাটি লেখক সম্পূর্ণ করেননি। লেখার নামটি মস্কোর মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ ইনস্টিটিউটের দেয়া। এতে মোট তিনটি পান্ডুলিপি আছে। প্রথমটির বড় অংশই প্রস্তুতিমূলক নোট, বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া অর্থশাস্ত্রীদের রচনার উদ্ধৃতি এবং মার্ক্সের বিশ্লেষণী মন্তব্য। এর বিষয়বস্তু হল শ্রমের মজুরী, পুঁজির মুনাফা, ভূমির খাজনা এবং বিচ্ছিন্ন করা শ্রম। শেষের বিষয়টি মার্ক্সের একটি স্বতন্ত্র রচনা। বর্তমান বাংলা সংস্করণে তা অনুদিত হয়েছে। দ্বিতীয় পান্ডুলিপির মাত্র চারটি পৃষ্ঠাই পাওয়া গেছে। তা এখানে পুঁজি ও শ্রমের এন্টিথিসিস। ভূ-গত সম্পত্তি ও পুঁজি শিরোনামে অনুদিত। তৃতীয় পান্ডুলিপিতে ব্যক্তি সম্পত্তি ও শ্রম, ব্যক্তি সম্পত্তি ও কমিউনিজম, বুর্জোয়া সমাজে অর্থের দাপট- বিষয়ে মার্ক্সের প্রায় সম্পূর্ণ লেখা আছে। তাই তা এই সংস্করণে সংকলিত হয়েছে। এই পান্ডুলিপির বড় এক অংশ সমগ্রভাবে হেগেলীয় ডায়ালেকটিক এবং দর্শনের পর্যালোচনার জন্য বরাদ্দ হয়েছে। এই অংশটি ব্যাপক বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনার অপরিহার্য দাবি তোলে। তার জন্য স্বতন্ত্র অবকাশ চাই বলে মনে হয়। ভাষান্তরের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব বোধগম্য করে তোলার প্রয়াসই ছিল মুখ্য। ইংরেজি হতে ভাষান্তর করতে গিয়ে পরিভাষার ভূত ছাড়িয়ে চলার চেষ্টা ছিল আপাত সর্বোচ্চ। টীকা, নামপঞ্জি নেয়া হয়েছে ইংরেজি সংস্করণ হতে। পরিভাষা পরিচয় সম্পাদকের প্রস্তুতকৃত। সম্পাদকীয পরিশিষ্ট রুপে দেয়া প্রবেশিকামূলক প্রস্তাবনা মার্কসের তৎকালীন বৌদ্ধিক পরিচিতি দিতে সাহায্য করতে পারে।খ.
১৮৪৪ সালে অর্থনৈতিক ও দার্শনিক খসড়া তৈরী হবার পর প্রায় একশো বছর লেখাটা সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞাত ছিল। ১৯৩০-এর পরে মস্কোর মার্ক্স-এঙ্গেলস ইনস্টিটিউট তা ছেপে বের করার আগে এমনকি খোদ মার্ক্স নিজেও এর কথা কাউকে বলেননি, কোন লেখায় এর উল্লেখও করেননি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী মহলে এর কদর বাড়ে। এই রচনাতে মার্ক্সের কিছু প্রস্তাবনা, যেমন- আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা আর একাকীত্বের মনস্তাত্ত্বিক আবেদন, কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁর আওয়াজ, অর্থ রূপে ঈশ্বর, ঈশ্বর রূপে অর্থের খাসলতের বিরুদ্ধে খারিজের ডাক ছিল এর কদর বাড়ার মূল কারণ। শুধুমাত্র এই খসড়ার মার্ক্স পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী অস্তিত্বের কাছে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বোধ হতে লাগলো। মার্ক্সের অধিকাংশ মূল প্রস্তাবনা গাঞ্চ না করেও মার্ক্স অনুসারী দাবি করার বাঁধা রইলো না। লক্ষ্মীর বদলে কুবেরের উপাসনা করা পশ্চিমা মানসে নিজের গা বাঁচিয়ে, অস্তিত্ব হুবহু টিকিয়ে রেখে, মনোজাগতিক আত্ম-পীড়ন থেকে বাঁচার আর ভালো পথ আসলেও ছিল না। বস্তু এবং ভাবের অভেদ বোধের বেনেডিক্ট স্পিনোজার প্রস্তাবনা থেকে ঐতিহাসিক বিচ্যুতি থেকে ফিরে আসতে গিয়ে বর্তমানকালের প্রতিচ্যে বহুরকম জ্ঞানকান্ডের জন্ম হচ্ছে। তাদেরকে প্রায়শঃ আমাদের বাস্তবতায় প্রয়োগে আমরা গন্ডগোলও বাধিয়ে বসছি। ভারচ্যুয়াল রিয়েলিটির সমাজ আর যাকাতের কাপড় নিতে গিয়ে পায়ের তলে পিষে মরার সমাজে জীবন্ত বাস্তবতায় ব্যাপক প্রামাণিক ফারাক থাকে। এই স্থানিক বৈশিষ্ট্য পণ্য বিশ্বায়নকে মোকাবিলায় একটি বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। কোকাকোলার মতো যদি সমকালীন জ্ঞানকান্ডগুলোকে ফর্মুলা গোপন রেখে চর্চা করা হয় তবে খুবই বিপদের কথা। বিচারহীন আস্থা বা অনাস্থা- উভয়ই পরিত্যাজ্য। তাই বিচার বলতে বোঝাবে কোন জিনিস (তা পোস্ট-মডার্ণিজম হোক, কোকাকোলাই হোক) সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার আগপাশতলা, কোন কারখানায়, কোন বাস্তবতায়, কোন কারণগুলো থেকে তা তৈরী হল তার বিস্তৃত অনুসন্ধান। এক্ষেত্রে জ্ঞানকান্ডগুলোর একে অপরের সাথে মতাদর্শিক লড়াইয়ের ময়দান তৈরী হওয়া খুবই প্রয়োজন। জগত আর জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়ে কাপুরুষতা কাজের কথা নয়।আজকের প্লেটো যেমন মার্ক্স পরবর্তী প্লেটো, আজকের মার্ক্সও সেই হিসেবের বাইরে থাকেন না। সুতরাং ভোগবাদী পণ্য সভ্যতার ইনস্ট্যান্ট কফির মতো ইনস্ট্যান্ট বিপ্লব তত্ত্বের আশা করে লাভ নেই। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নকে রুখতে হলে শুধু আমাদের বিপন্নতার অজুহাত তো তারা মানবে না, তার যে উৎকট দর্শন সে দর্শনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বুঝ্-সবক নিয়েই তার প্রাণ ভোমরাকে পিষে মারতে হবে। ইতিহাসের বৈপ্লবিক রূপান্তরের ক্ষমতা অর্জন আমাদের জন্য তত্ত্ব বিলাসিতা নয়, বরং বাঁচা মরার প্রশ্ন। এ কথা মনে এবং মগজে রেখে এগোনো বাঞ্ছনীয়।